BANGLA




এ বছর বর্ষাটা বেশ জেঁকে বসেছে। একেবারে আষাঢ়ের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি-জলের গান। আকাশ অন্ধকার করে, মেঘলা গলির কিনারা ঘেঁষে বৃষ্টি এসে নামছে আমাদের প্রাত্যহিক বারান্দায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যা থেকে রাত্রি। তারপর রাত্রির সুগভীর সুনশান ভেদ করে আবার শুরু হয় বৃষ্টি। এ যেনো পুরো সময় জুড়ে থাকা বৃষ্টির সাহানা সুর- আলিঙ্গন করে রাখে আমাদের একেবারে নিত্য নবীনা মায়ের মতোন। এ রকম বৃষ্টি যখন ঘরে-বাইরে, হৃদয়ে-বন্দরে নিবিড়তায় ছেয়ে থাকে- তখন ঘরের কোণে বসে কিংবা গরম চায়ের আড্ডায় আমরা প্রায়ই বলে থাকি- এবারে বর্ষাটা যা হচ্ছে- শীতটা এবার কম হবে। অনেকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়; সে কী! তুমি কী করে বললে? আমরা তখন চট করে বলে দিই- উনো বর্ষায় দুনো শীত। এর অর্থ হলো, যে বছর বৃষ্টি কম হয়, সে বছর শীতের থাকে প্রবল প্রতাপ। আবার বর্ষার প্রতাপে শীত পড়ে ঝিমিয়ে। এ খনার বচন আমাদের সে-ই পুরোনো পড়া। মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়েছিলাম, ‘পল্লী- সাহিত্য’ প্রবন্ধে। কী অসাধারণই না ছিলো সে-ই প্রবন্ধটি। কতো আদরের কথা, বাঙলা মায়ের কোলের কথা সে-ই প্রাঞ্জল প্রবন্ধে আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরেছিলো অচেনা এক সুখপাখির মতো। মদিনা বিবির কথা, রঁমা-রঁলার কথা, ময়মনসিংহ গীতিকার নির্যাস- ছোট্ট সে-ই প্রবন্ধের মধ্যে কী ছিলো না?

সেই আমাদের প্রথম পল্লী-সাহিত্যের হাতেখড়ি। ফোকলরের বড়ো বড়ো কথা আমরা বুঝতাম না, যা ভাবতাম, তা সত্যিকার অর্থে ভাবনাও ছিলো না- ছিলো বালখিল্যতা; তবুও মনের কোণে লুকিয়ে ছিলো পল্লী-সাহিত্যের জন্য মমতা। ওটুকু মমতা না বুঝেই জন্মেছিলো, চাঁদের আলো যেমন সন্তর্পণে এসে পড়ে নদীর বুকে- সে রকম।
আমাদের জন্য ‘পল্লী-সাহিত্য’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রবন্ধের শুরুতে লেখক পরিচিতি পড়ে আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম- কতো বিদ্বান মানুষের লেখা আমরা পড়ি, নিজেদের বেশ বড়ো মনে হতো। পরে দেখলাম সত্যিকারের বড়ো মানুষরা ছোটোদের জন্য ছোটোদের মতোই লিখেন। স্টিথ্ থমসনের সংজ্ঞা ছাড়াও ফোকলোরের উপস্থাপনা হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। পাখির শীস, বাউলের গান, ধান ভাঙার গীত, খনার বচনের আলো-আঁধারেও আমি ঠিক চিনে নিতে পারি আমার পল্লী-সাহিত্যকে। যিনি হাত ধরে চিনিয়েছিলেন- তিনি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর কতোগুলো পরিচয় দেবো? তাঁকে বোঝার কতোটুকু ক্ষমতাই বা আছে আমাদের? তিনি ছিলেন এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাতত্ত্ববিদ, জ্ঞানতাপস, ভাষাবিদ, গবেষক, লোকবিজ্ঞানী, অনুবাদক, পাঠ-সমালোচক, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিক, কবি, ভাষা-সৈনিক। জ্ঞানপ্রদীপ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন বাঙলা ভাষার গবেষণায় অদ্বিতীয়। তিনি ছিলেন একটি কাল, একটি শতাব্দী, একটি জাতি, একটি সংস্কৃতি; অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, ধর্মবেত্তা ও সূফীসাধক। আর সবকিছুর উর্ধ্বে তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি, তাঁর হৃদয়ের আরশিতে বাঙালির, আর একটু ছোটো করে বললে (কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে নয়) বাঙালি মুসলমানের যে অবয়বটি ধরা পড়ে- তা তুলনারহিত।
আসছে ১০ জুলাই তাঁর জন্মদিন; আর ১৩ জুলাই তাঁর প্রয়ান দিবস। এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জন্য রইলো হৃদয় মন্দিরের নৈবেদ্য।
‘জ্ঞানানন্দ সংগ্রামী’ থেকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা-মার পঞ্চম সন্তান। তাঁর বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন ইংরেজ আমলে সরকারি জরিপ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। শহীদুল্লাহর মাতা হরুন্নেছা খাতুনের শিক্ষার প্রতি ছিলো প্রচণ্ড আগ্রহ। তিনি বাড়িতে তাঁর পরিবার ও পেয়ারা গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের শিক্ষা দিতেন। প্রথম দিকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম রাখা হয় মুহম্মদ ইব্রাহীম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পিতার পছন্দে আকিকা করে তাঁর নাম পুনরায় রাখা হয় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। পরিবারে তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে শহীদুল্লাহ ছোটোবেলায় ছিলেন দারুণ আমুদে ও আত্মভোলা। বাড়ির সবাই আদর করে তাঁকে ডাকতেন ‘সদানন্দ’ বলে। গ্রামের পাঠশালায় পণ্ডিত মশাইরা তাঁকে ডাকতেন ‘সিরাজ দৌলাহ’ নামে। কিন্তু তিনি নিজের নাম রেখেছিলেন ‘জ্ঞানানন্দ সংগ্রামী’।
শিক্ষা তোমার নাম কী?
ছোটোবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে শহীদুল্লাহ উর্দূ, ফার্সী ও আরবি শেখেন এবং গ্রামের পাঠশালায় সংস্কৃত পড়েন। পাঠশালার পড়া শেষ করে ভর্তি হন হাওড়া জেলা স্কুলে। স্কুলের ছাত্র থাকতেই বই পড়ার এবং নানা বিষয়ে জানার প্রতি ছিলো তাঁর দারুণ নেশা। হাওড়া স্কুলের স্বনামখ্যাত ভাষাবিদ আচার্য হরিনাথ দে’র সংস্পর্শে এসে শহীদুল্লাহ ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি আরবী-ফার্সী-উর্দূর পাশাপাশি হিন্দি ও উড়িয়া ভাষা পড়তে শিখেছিলেন। ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে সংস্কৃতসহ প্রবেশিকা পাশ করেন। এরপর কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে থেকে ১৯০৬ সালে এফ.এ পাশ করেন। অসুস্থতার কারণে অধ্যয়নে সাময়িক বিরতির পর তিনি কোলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন ১৯১০ সালে। বাঙালি মুসলমান ছেলেদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম অনার্স নিয়ে পাস করেন।
কিন্তু সংস্কৃতের হিন্দু শিক্ষক সত্যবৃত সামশ্রমী একজন মুসলমান ছেলেকে সংস্কৃতের শাস্ত্র ‘বেদ’ পড়াতে কিছুতেই রাজি হলেন না। ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা সত্ত্বেও সংস্কৃত পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেখে শহীদুল্লাহ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি দিল্লি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, শহীদুল্লাহকে সংস্কৃতি পড়তে দেওয়া হোক, অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্য একটি সাবজেক্ট চালু করে তাকে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হোক। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদালতের দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী ‘ভাষাতত্ত্ব বিভাগ’ নামে নতুন একটি অনুষদ চালু করেন। ফলে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে এ বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এর দু’বছর পর ১৯১৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ গমন করেন। বাঙলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদাবলী বিষয়ে গবেষণা করে ১৯২৮ সালে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ধ্বণিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্যে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা লাভ করেন।
আঠারো শতকের মুসলিম সমাজ, পারিবারিক ঐতিহ্য ও পৈত্রিক পেশা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন। ভাষাবিজ্ঞানের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তিনি সচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন, আয়ত্ত করেছিলেন বাইশটি ভাষা। তিনি বাঙলা, উর্দূ, ইংরেজী, হিন্দী, সংস্কৃত, পালি, আসাম, উড়িয়া, আরবী, ফার্সী, হিব্রু, আবেস্তান, ল্যাটিন,তিব্বতী, জর্মান, ফরাসি, প্রাচীন সিংহলী, পশতু, মুন্ডা, সিন্ধী, মারহাটী, মৈথালী ইত্যাদি ভাষা জানলেও ভাষার ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সানন্দে বলতেন, আমি বাঙলা ভাষাই জানি।
যে জীবন জ্ঞানের সে জীবনেই কর্ম গড়ে মাহাত্ম্যের সৌধ
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯১৪ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে সিতাকুন্ডু উচ্চ বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি কিছুদিন ওকালতি ব্যবসা করেন। তিনি বশিরহাট মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিনেশ চন্দ্র সেনের অধীনে শরৎচন্দ্র লাহিরী রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সে বছরের ২ জুন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাঙলা বিভাগে প্রভাষক পদে স্থায়ী চাকুরিতে যোগদান করেন। একইসঙ্গে নিখরচে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সভাপতি নিযুক্ত হন। পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে ১৯২৮ সালে দেশে ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলা ও সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষকের এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষকের পূর্বপদে যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি রীডার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। একই বছর তিনি সংস্কৃত ও বাঙলা বিভাগের অধ্যক্ষ এবং পরে ১৯৩৭ সালে স্বতন্ত্র বাঙলা বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সালের ৩০ জুন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগ থেকে রীডার ও অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং একইসাথে উক্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও ছয় বছর কলা অনুষদের ডীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগে বাঙলা সাহিত্য ও বাঙলা ভাষা গড়ে তোলার জন্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি সেখানে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের অস্থায়ী প্রাধ্যক্ষের এবং ফজলুল হক হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর এমেরিটাস নিযুক্ত হন। অধ্যাপনার বাইরে তিনি করাচির উর্দূ উন্নয়ন সংস্থার উর্দূ অভিধান প্রকল্প, ঢাকায় বাঙলা একাডেমীর ‘পূর্ব পাকিস্তান ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ এবং ‘ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পে’ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিশনের সদস্য, ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বহি কমিটির সদস্য, বাংলা একাডেমীর বাঙলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজি সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মাদ্রাজে Seminar on Traditional Culture in South-East Asia -তে তিনি UNESCO -র প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এর চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
ভাষা আন্দোলন ও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দূকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। এর প্রতিবাদে প্রথম লেখনি ধারণ করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ প্রবন্ধে বলেন,
“পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন, যেমন পশতু, বেলুচি, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা; কিন্তু উর্দূ পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই মাতৃভাষা রূপে চালু নয়। … যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যক্ত হয়,তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করিতে হয়, তবে উর্দূ ভাষার দাবী বিবেচনা করা কর্তব্য। … বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দূ বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দূ ভাষার স্বপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি।”
এই প্রতিবাদ অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে শুরু করেছিলো রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের। ডক্টর শহীদুল্লাহ রয়ে গেলেন বিতর্কের কেন্দ্রে। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন,
“আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালল-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি দাড়িতে ঢাকবার কোন জো-টি নেই।”
১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা দিবসে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের ছাত্রদের আহ্বানে তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মাঝে সশরীরে উপস্থিত থেকে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পুলিশি হামলায় টিয়ার গ্যাসে নিগৃহীত হয়েছেন।
মনন ও আধুনিকতার সত্যিকারের রূপ
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবন-দর্শনের ভিত্তি ছিলো ইসলামি বিশ্বাস। তিনি যেমন পারিবারিকভাবে ইসলামিক পরিম-লে বেড়ে উঠেছেন, ঠিক তেমনি তাঁর সাংসারিক জীবন এবং কর্মক্ষেত্রের সর্বত্র ইসলামের প্রতিফলন ঘটেছিলো। তিনি কখনো ধর্মীয় রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা এবং ধর্মের অপব্যবহারকে প্রশ্রয় দেননি। স্ব-ধর্মে নিষ্ঠাবান থেকে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রচেষ্টা করে গেছেন আজীবন। ১৯৫০ সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়ে সুধীজনেরা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তার খসড়া ছিলো তাঁরই রচনা। বছরের শেষ দিকে ‘আঞ্জুমান-ই-ইশা আৎ-ই-ইসলাম’ নামে ইসলাম প্রচার সমিতি গঠন করেন তিনি।
বাঙালি মুসলমান সমাজে নারীর ধর্মসম্মত অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি অত্যন্ত উদ্যেগী ছিলেন। তাঁর মতে, পর্দা দু’রকম এক রকম হলো- ইসলামিক পর্দা, সেটি হচ্ছে মুখ হাত-পা ছাড়া সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখা, আর এক রকম হলো- অনৈসলামিক পর্দা, সেটি মেয়েদের চার দেয়ালের মধ্যে চিরজীবনের জন্যে কয়েদ করে রাখে। ইসলামি পর্দায় বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরুনো কিংবা অন্যের সঙ্গে দরকারি কথাবার্তা বলা মানা নয়; তবে অনৈসলামী পর্দায় এসব হবার জো নেই। সবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে এই অনৈসলামীক পর্দা সরিয়ে দিতে। তা না হলে সবার নারীহত্যার মতো মহাপাপ হবে। নারী যে মসজিদে যেতে পারে, পুরুষের ইমামতিতে নামাজ আদায় করতে পারে এবং শুধু প্রাচীন আরবে নয়, মুসলিম আমলের বাঙলাদেশেও যে এ প্রথা প্রচলিত ছিলো-তিনি তার প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন এবং ঢাকায় নারীদের জামাতে তিনিই প্রথম ইমামতি করেছিলেন।
তাঁর দীর্ঘ জীবনে তৎকালীন পরিবর্তনশীল সামাজিক রুচির যে ধারা চলছিলো তার সাথে তিনি সহ-অবস্থান নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক থাকাকালীন তিনি ছাত্রদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। আবার Traditional culture of east Pakistan গ্রন্থে তিনি Folk Dance, Folk Music, Folk Arts সম্পের্ক প্রবন্ধ লিখেছেন; শুধু তাই নয়, একটি প্রবন্ধে তিনি “Educated and talented dancers of our country can draw profitable on this indigenous dances and add new color and life to the art of dancing.”
স্বদেশী আন্দোলনে তাঁর অবদান
স্বদেশী আন্দোলনের সময় চারদিকে যখন বিদেশী পণ্য বর্জনের ডাক শুরু হয়ে গেছে; ঠিক তখন থেকেই তিনি সাহেবি প্যান্ট-কোর্ট ছেড়ে দিয়ে খদ্দর কাপড়ের আচকান, পায়জামা ও পাঞ্জাবী পরিধান শুরু করে দিলেন। তিনি মনে করতেন, দেশি জিনিস ব্যবহার করলে দেশে পয়সাটা থাকে আর বিদেশী জিনিস ব্যবহারে দেশের পয়সাটা বিদেশে চলে যাবে।
আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর চিন্তার প্রতিফলন
জ্ঞানতাপস এই শিক্ষাবিদ নিজে যেমন আজীবন জ্ঞান সাধনা করেছেন, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে নিজকে আত্মনিয়োগ করেছেন। আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। কেবল সমালোচনাই করেননি, তিনি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য নানা ধরণের দিক-নির্ধেশনাও রেখে গেছেন। তৎকালীন সরকারের অনুমোদিত নিউস্কীম মাদ্রাসা, ওল্ডস্কীম মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষা এই তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করেন তিনি। তাঁর মতে, এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষাক্ষেত্রে কেবল গ-গোলই সৃষ্টি করেছে এবং মুসলমান সমাজে অনৈক্য এনেছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় মানুষের অধিকার তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি। তাই শিক্ষার কথা যখনই বলেছেন তখনই তিনি সার্বজনীন শিক্ষার অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেছেন। দেশের প্রতিটি নাগরিকের ষোলো বৎসর বয়স পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন করা সরকারের আশু কর্তব্য বলে তিনি বিবেচনা করতেন। মাদ্রাসা শিক্ষার বর্তমান প্রণালীকে তিনি সময় ও শক্তির অপচয় বলে মনে করতেন। শিক্ষাক্ষেত্রে যে একটিমাত্র ব্যবস্থার পরিকল্পনা তাঁর ছিলো, সেখানে ধর্মশিক্ষার একটা বিশিষ্ট স্থান ছিলো।
বাঙলা ভাষার গবেষণায় তিনি হিমালয়সম
বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি নিজস্ব আসন আছে। এই দুই ক্ষেত্রেই তিনি কিছু মৌলিক ধারণার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯২০ সাল থেকে নানা প্রবন্ধ লিখে তিনি নিজের যে বক্তব্য তুলে ধরতে থাকেন তার চূড়ান্ত ও ধারাবহিক রূপ দেখা যায় তাঁর ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ (১৯৫৬) গ্রন্থে।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক স্বতন্ত্র ধর্মী গবেষক ছিলেন। তাঁর গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিলো জটিল দিকের গ্রন্থিমোচন এবং নবতর ব্যাখ্যা। বাঙলা লোকসাহিত্যের প্রতিও তিনি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। গবেষণাগ্রন্থের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য এবং শিশু সাহিত্যের অনেক মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। বাঙলার গঠন অনুসারে তিনিই প্রথম ১৯৪৩ সালে বাংলা ব্যাকরণ রচনায় হাত দেন। তাঁর অবিস্মরণীর কৃতিত্ব হলো বাংলা একাডেমী থেকে দু’খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষার আঞ্চলিক অভিধান’ সম্পাদনা। তিনিই প্রথম ১৯৪০ সালে ভারতের মুসলিম শিক্ষা কংগ্রেসে পূর্ব বাঙলায় ভাষা চর্চা উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রস্তাব করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ সম্মেলনে তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘বাংলা একাডেমী’ রাখার প্রস্তাব করেন।
গবেষণাগ্রন্থ: সিদ্ধা কানুপার গীত ও দোহা (১৯২৬), বাংলা সাহিত্যের কথা (১ম খণ্ড ১৯৫৩, ২য় খণ্ড ১৯৬৫), বৌদ্ধ মর্মবাদীর গান (১৯৬০)।
ভাষাতত্ত্ব: ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১), বাংলা ব্যাকরণ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৬৫)।
প্রবন্ধ-পুস্তক: ইকবাল (১৯৪৫), আমাদের সমস্যা (১৯৪৯), বাংলা আদব কি তারিখ (১৯৫৭), Traditional culture in East Pakistan (মুহম্মদ আবদুল হাই-এর সঙ্গে তাঁর যুগ্ম-সম্পাদনায় রচিত; ১৯৬১) ।
গল্পগ্রন্থ: রকমারী (১৯৩১) ।
শিশুতোষ গ্রন্থ: শেষ নবীর সন্ধানে, ছোটদের রাসূলুল্লাহ (১৯৬২), সেকেলের রূপকথা (১৯৬৫)।
অনুবাদ গ্রন্থ: দাওয়ানে হাফিজ (১৯৩৮), অমিয়শতক (১৯৪০), রুবাইয়াত-ই-ওমর খয়্যাম (১৯৪২), শিকওয়াহ ও জাওয়াব-ই-শিকওয়াহ (১৯৪২), বিদ্যাপতি শতক (১৯৪৫), মহানবী (১৯৪৬), বাই অতনা মা (১৯৪৮), কুরআন প্রসঙ্গ (১৯৬২), মহররম শরীফ (১৯৬২), অমর কাব্য (১৯৬৩), ইসলাম প্রসঙ্গ (১৯৬৩),Hundred Sayings of the Holly Prophet (১৯৪৫), Buddhist Mystic Songs (১৯৬০)।
সংকলন: পদ্মাবতী (১৯৫০), প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে শেষ নবী (১৯৫২), গল্প সংকলন (১৯৫৩)।
তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। এছাড়া তিনি ৪১টি পাঠ্যবই লিখেছেন, ২০টি বই সম্পাদনা করেছেন। বাঙলা সাহিত্যের উপর তাঁর লিখিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। ভাষাতত্ত্বের উপর রয়েছে তার ৩৭টি রচনা। অন্যান্য বিষয়ে বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮০টি। এ ছাড়া তিনি তিনটি ছোটগল্প এবং ২৯টি কবিতা ও লিখেছেন।
অন্য আলোর গান
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যখন বাঙলা ভাষার প্রথম সহজবোধ্য ‘বাংলা ব্যাকরণ’ লিখলেন তখন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুশি হয়ে তাঁকে একটি চিঠি লিখেন। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আপনার বাংলা ব্যাকরণখানি পড়ে বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছি। ব্যাকরণখানি সকল দিকেই সম্পূর্ণ হয়েছে। এতে ছাত্রদের উপকার হবে। বইখানি আমার শান্তি নিকেতনের বাংলা বিভাগের অধ্যাপকদের দেব। তাঁরা তা শ্রদ্ধাপূর্বক ব্যবহার করবেন।’
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিশু-কিশোরদের জন্য ‘আঙুর’ পত্রিকা বের করার পর একে স্বাগত জানিয়ে পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত লোকসাহিত্যিক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, ‘আপনার মত এত বড় পণ্ডিত, যাহার বিদ্যার পরিধি আয়ত্ত করিবার সাধ্য আমাদের নাই, যিনি বেদ-বেদান্তের অধ্যাপক, ফার্সি ও আরবী যার নখদর্পণে, যিনি জার্মান ব্যাকরণের জটিল বুহ্য ভেদ করিয়ে অবসর রঞ্জন করে-তিনি একটি ‘আঙুর’ হাতে নিয়া উপস্থিত!”
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও তাঁর পরিবার
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর স্ত্রীর নাম মরগুবা খাতুন। তিনি সাত পুত্র ও দুই কন্যার জনক। মাহযূযা খাতুন, আবুল ফযল মুহম্মদ সফীয়্যুল্লাহ, মাসব্দরা খাতুন, আবুল কালাম মোস্তফা ওলিয়ুল্ল্যাহ, আবুল করম মাহমুদ যকীয়্যুল্লাহ, আবুল জামার মহামেদ তকীয়্যুল্লাহ, আবুল বয়ান মুজতাবা নকীয়্যুল্লাহ, আবুল ফসল মুতাওয়াক্কিল ববীয়্যুল্লাহ, আবুল খায়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন আজীবন ছাত্র এবং আজীবন শিক্ষক। সারাটি জীবন শুধু জ্ঞানের পিছু ছুটেছেন এবং জ্ঞান বিলিয়ে দিয়েছেন সবার মাঝে। অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ ও আবুল কাশেম সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মিরপুরে প্রতিষ্ঠা করেন বাঙলা কলেজ। মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই শিক্ষক তিনি; একই কারণে দেশপ্রেমিক এবং মনেপ্রাণে বাঙালি।
জীবনের ওপার সন্ধ্যায় যা আছে
জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ এই জ্ঞানতাপস পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান’ এবং ১৯৬৭ সালে ফরাসী সরকার তাঁকে ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্ট লেটার্স’ পদকে ভূষিত করেন। আজীবন উদ্যমী এই মানুষটি সর্বদা ছিলেন কর্মচঞ্চল। ১৯৬৭ সালে ২৭ ডিসেম্বর প্রথম সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হন এই জ্ঞানানন্দ প্রবাদপুরুষ। জীবন সায়াহ্নে যখন হাসপাতালের বিছানায়, তখন ডান হাতের লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। খুব দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘ভালো হয়ে নিই, আমার বাম হাতে লেখার অভ্যাস করবো’। ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই সুদীর্ঘ কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর। ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন মূসা খাঁন মসজিদের পশ্চিম পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
তবুও কথা থেকে যায়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার। বর্তমানে যেটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ সেটিই বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর দিকে ব্যবহৃত হয়ে আসছিলো গ্রন্থাগার হিসেবে। সেই গ্রন্থাগারে একজন বইপাগল, শান্ত, সৌম্য, শুভ্র-শ্মশ্রুমণ্ডিত ব্যক্তি মোটা ফ্রেমের চশমা পরে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো ডুবে আছেন মোটা মোটা বইয়ের গুরুগম্ভীর লেখার জ্ঞান সমুদ্রে। দুপুর গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিমের রক্তিম সূর্য যখন তার লাল আভা মিলিয়ে দিয়েছে নীলিমায়, তখনও তিনি পড়েই চলেছেন। আর ততোক্ষণে গ্রন্থাগারের দারোয়ান তালা লাগিয়ে চলে গেছে।
ঢাকার চকবাজারের লাগোয়া বেগমবাজার। বেগমবাজারের দক্ষিণ উপপ্রান্তে জনাকীর্ণ পথের কোণাকুণি জায়গাটায় একখানি দ্বিতল পাকাবাড়ি, নাম ‘পেয়ারা ভবন’। বাড়িটির মাঝখান দিয়ে একটা সরু করিডর। করিডর দিয়ে সামনের দিকে এগুলে সিঁড়ি বেয়ে সোজা দোতালায় ওঠা যায়। নিচ তলায় একটি পড়ার ঘর এবং লাইব্রেরি। সেখানে বিভিন্ন ভাষার হরেক রকমের অসংখ্য বই। বাঙলা, ইংরেজী, জার্মান, ফরাসী, ল্যাটিন, হিব্রু, আরবী, ফার্সী, উর্দূ, হিন্দী, আসামীয়, উড়িয়া, মারাঠি, তামিল, গুজরাটি, সিংহলীসহ দেশী-বিদেশী নানা ভাষার লক্ষ লক্ষ শব্দ বন্দী হয়ে আছে সেই বইগুলিতে। আর বইগুলি থরে থরে সাজানো আছে আলমারীতে ও শেলফে এবং প্রত্যেকটি বই আচার্যের বহু বিনিদ্র রজনীর পড়াশুনার স্মৃতি বহন করছে। যিনি হামেশা বলতেন ‘দেখো, ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার না হলে কেউ লেখক হতে পারে না। হতে পারে না গবেষক ও পণ্ডিত। লেখক ও সাহিত্যিক হওয়ার পূর্বশর্ত হলো মূল্যবান গ্রন্থের সংগ্রহশালা।’
শেষ নাহি যে
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাঙলা ভাষা ও বাঙলা ব্যাকরণের জন্য যা করেছেন তা প্রবাদ প্রতিম। বাঙলা ভাষাকে এবং বাঙলার ক্রোড়ে লালিত আজন্ম সুধা বিধৌত শিল্প-সাহিত্যকে তিনি সুউচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। কিন্তু আমাদের দুর্বলতা এবং কাপুরুষতা এতোটাই রূঢ় যে এই মহামনীষী এখন বছরের দুইদিন সংবাদপত্রের শেষ পাতায় মাত্র এক কলাম দু-ইঞ্চি জায়গা পান- তাও সব পত্রিকায় পান না। এটা আসলে আমাদেরই অপমান এবং আমরাই এতে ছোটো হই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তাঁর মেধা ও শ্রম উজাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু একবার তাকাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে- এতো বছরেও সেখানে ফোকলোর বিভাগ খোলা হলো না; মনে প্রশ্ন জাগে- কেনো? অথচ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকই বিভাগটি খোলা হয়েছে এবং এ বিভাগের মাধ্যমে ফোকলোর নিয়ে ভালো কাজও হচ্ছে। আমি মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনতিবিলম্বে এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
জ্ঞান-তাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সড়ক নামকরণ করা হয়েছে আনন্দবাজারের রাস্তাটির। হায় রে বেহাল দশা! মাদকের রাজ্যে বুড়ি চাঁদও সেখানে লজ্জা পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের কতোজন শিক্ষার্থী জানে এই মহান মানুষটির সম্বন্ধে? এ অজ্ঞতা আমাদের লজ্জা এবং আমরা নির্লজ্জের মতো একে ধারণ করছি।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঘুমিয়ে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলস্থ মুসা খানের মসজিদের পাশেই। প্রতিদিন হয়তো চেনা-অচেনা নানা পাখি তাঁকে গান শুনিয়ে যায়, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। আর দূরে কোথাও কোনো এক তরুণ গবেষক হয়তো বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখা মমতার স্পর্শে গবেষণার আকাশগঙ্গা সাজায় বাঙলা ভাষাকে নিয়ে। পাখি আর গবেষকের এই গল্পে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কিংবদন্তী হয়ে থাকেন। আজ থেকে হাজার বছর পরেও থাকবেন। এবং তারও হাজার বছর পরে। ইতিহাসের ঘরে প্রদীপ জ্বালালে এর চেয়ে বড়ো কোনো সত্য আর চোখে পড়ে না।
তথ্যসূত্র:
১. সংসদ বাঙালা চরিতাবিধান; সাহিত্য সংসদ;
২. আচার্য সুনীত কুমার চট্টোপাধ্যায়; বাংলা সাহিত্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ.বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি
৩. চরিতাবিধান, বাংলা একাডেমী;
৪. ‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও আমি’; মাহযূযা হক, ২০০০ প্রকাশিত।
৫. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, হোসাইন মোঃ আল-জুনায়েদ









                                                       

                              হুমায়ুন আজাদ




হুমায়ুন আজাদ (জন্ম: ২৮শে এপ্রিল, ১৯৪৭ (১৪ই বৈশাখ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), রাড়িখাল, বিক্রমপুর; মৃত্যু: ১১ই আগস্ট, ২০০৪, মিউনিখ, জার্মানি) একজন বাংলাদেশী কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং কলাম প্রাবন্ধিক। [১] ৭০ টি'র উপর তার রচনা রয়েছে। প্রথাবিরোধী লেখক হিসাবে তার সুনাম আছে।

সূচিপত্র

 [আড়ালে রাখো

[সম্পাদনা] ব্যক্তিগত জীবন

হুমায়ুন আজাদ রাড়িখালের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। মেধাবী ছাত্র আজাদ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন; উভয় ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ। তাঁর স্ত্রী লতিফা কোহিনুর। তাঁর দুই কন্যা মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং একমাত্র পুত্র অনন্য আজাদ। ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদের উপর সন্ত্রাসী হামলা হয়, যার দায়িত্ব পরবর্তীতে জমিয়াতুল মুজাহেদীনের জঙ্গী সন্ত্রাসবাদীরা স্বীকার করে। হুমায়ুন আজাদ ১১ আগষ্ট ২০০৪ সালে জার্মানির মিউনিখ শহরে মৃত্যুবরণ করেন। [২]

[সম্পাদনা] ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ

হুমায়ুন আজাদ যখন ৬০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ছিলেন, তখন ভাষাবিজ্ঞানে চম্‌স্কি-উদ্ভাবিত সৃষ্টিশীল রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ তত্ত্বটি আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। আজাদই প্রথম এই তত্ত্বের কাঠামোর উপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার গবেষণার একটি অবহেলিত ক্ষেত্র বাক্যতত্ত্ব নিয়ে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন ও বাংলা ভাষার গবেষণাকে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে উত্তরণ ঘটান। আজাদের পিএইচডি অভিসন্দর্ভের নাম ছিল Pronominalization in Bengali (অর্থাৎ বাংলা সর্বনামীয়করণ)। পরবর্তীতে এটি একই শিরোনামের ইংরেজি বই আকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। এর পর ১৯৮৪ সালে আজাদ বাংলা বাক্যতত্ত্বের উপর বাক্যতত্ত্ব নামে একটি বাংলা বই প্রকাশ করেন। একই সালে তিনি বাঙলা ভাষা শিরোনামে দুই খণ্ডের একটি সঙ্কলন প্রকাশ করেন, যেটিতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপর বিগত শতাধিক বছরের বিভিন্ন ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকের লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক রচনা স্থান পায়। এই তিনটি গ্রন্থই ছিল তৎকালীন বাংলা ভাষাবিজ্ঞানের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা। পরবর্তীতে আজাদ তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান ও অর্থবিজ্ঞানের উপর দুইটি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক লেখেন। ৯০-এর দশকের শেষের দিকে আজাদ বাংলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং এই ব্যাপারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যাপক পরিকল্পনাও যে তিনি করছিলেন, তাঁর বিভিন্ন উক্তিতে তার প্রমাণ মেলে। তবে দুর্ভাগ্যবশত তিনি তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি।

[সম্পাদনা] সাহিত্যকৃতি

[সম্পাদনা] কবিতা

তাঁর প্রথম কাব্যগন্থের নাম 'অলৌকিক ইস্টিমার' যা প্রথম প্রকাশিত হয় পৌষ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দে (জানুয়ারি ১৯৭৩)। কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন ১৯৬৮- ৭২ এর রাতদিনগুলোর উদ্দেশে।
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'জ্বলো চিতাবাঘ। প্রথম প্রকাশ হয় ফাল্গুন, ১৩৮৬ বঙ্গাব্দে (মার্চ ১৯৮০)
'সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে' তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রথম প্রকাশের সময় বৈশাখ ১৩৯২ বঙ্গাব্দ (এপ্রিল, ১৯৮৫)। কাব্যগ্রন্থটি বাংলাভাষার সাম্প্রতিক সময়ের দুইজন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ (এইক্ষেত্রে হুমায়ূনের হু-টা অন্য রকম হওয়ার কথা) এবং ইমদাদুল হক মিলন কে উৎসর্গিত।
১৩৯৩ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে (মার্চ ১৯৮৭) প্রকাশিত হয় তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ' যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল'
'আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে' প্রকাশিত হয় ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে (ফেব্রুয়ারি ১৯৯০) প্রথমবারের মত। এটি তাঁর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ।
এর আট বছর পর ১৪০৪ এর ফাল্গুনে (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮) প্রকাশিত হয় তার ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু'। কাব্যগ্রন্থটি কবি তার 'প্রিয় মৃতদের জন্য' উৎসর্গ করেন।
সপ্তম কাব্যগ্রন্থ 'পেরোনোর কিছু নেই প্রকাশিত হয় ১৪১০ বঙ্গাব্দের মাঘ(ফেব্রুয়ারি, ২০০৪) মাসে।এটিই হুমায়ুন আজাদের শেষ কাব্যগ্রন্থ।
তবে হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর বঙ্গাব্দ ১৪১১ এর ফাল্গুনে (ফেব্রুয়ারি,২০০৫) এই সাতটি কাব্যগ্রন্থ সহ আরো কিছু অগ্রন্থিত ও অনূদিত কবিতা নিয়ে তাঁর 'কাব্যসমগ্র' প্রকাশিত হয়।

[সম্পাদনা] উপন্যাস

মূলতঃ গবেষক ও প্রাবন্ধিক হলেও হুমায়ূন আজাদ ১৯৯০-এর দশকে একজন প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০০৪ খৃস্টাব্দে মৃত্যু অবধি তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৩। তাঁর ভাষা দৃঢ়, কাহিনীর গঠন সংহতিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক দর্শন স্বতঃস্ফূর্ত। তবে কাহিনীতে যৌনতার ব্যবহার কখনো কখনো মাত্রাতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় হয়েছে বলে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। শেষ দিককার কয়েকটি উপন্যাসে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি মূলতঃ রাজনৈতিক রচনার শিল্পরূপকে ক্ষুণ্ণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
মূলত ১৯৯৪ সালে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন প্রথম উপন্যাস ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের মধ্যে দিয়ে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে। আর এই বইয়ের জন্য তিনি বাংলা একাডেমীর পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০২ সালে ১০০০০ এবং আরও একটি ধর্ষণ, ২০০৩ সালে একটি খুনের স্বপ্ন এবং ২০০৪ সালে প্রকাশিত পাক সার জমিন সাদ বাদ-এর মতো একটি অসাধারণ নতুন মাত্রার উপন্যাস।

[সম্পাদনা] প্রবন্ধ

১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধের বই নারী। আর এই বইয়ের প্রকাশের পর তিনি মৌলবাদীদের তীব্র রোষানলে পড়েন। মৌলবাদীদের ঘৃণ্য চেষ্টার প্রভাবে ১৯৯৫ সালে নারী বইটি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ সরকার। দীর্ঘ ৪ বছর পর ২০০০ সালে বইটি আবার আলোর মুখ দেখে।

[সম্পাদনা] রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দর্শন

[সম্পাদনা] মৃত্যু

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে ঘাতকদের আক্রমণের শিকার হন তিনি। হত্যাপ্রচেষ্টা ঘটনার কিছুদিন পরেই জার্মান সরকার তাকে সেই কাজ করার জন্য বৃত্তি দেয়। ২০০৪-এর ৭ আগস্ট জার্মান কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান।[৩] ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হুমায়ুন আজাদ। ১২ আগস্ট তার ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। জার্মানি যাওয়ার মাত্র পাঁচ দিন পর তার এই মৃত্যু রহস্যময় প্রতীয়মান হয়েছে। ড. হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর জার্মান সরকারের তত্ত্বাবধানে মিউনিখে তার এপার্টমেন্টে পাওয়া সব জিনিসপত্র ঢাকায় তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। ওই জিনিসপত্রের ভেতরেই পাওয়া যায় তার হাতের লেখা তিনটি চিঠি। চিঠি তিনটি আলাদা তিনটি পোস্ট কার্ডে লিখেছেন বড় মেয়ে মৌলিকে, ছোট মেয়ে স্মিতাকে এবং একমাত্র ছেলে অনন্য আজাদকে। অনুমান করা হয়, ওই লেখার অক্ষরগুলোই ছিল তার জীবনের শেষ লেখা।[৪] তাঁর মরদেহ কফিনে করে জার্মানি থেকে ঢাকায় আনা হয় এবং জন্মস্থান রাড়িখালে ইসলামি পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক দাফন করা হয়।

[সম্পাদনা] প্রকাশিত গ্রন্থাবলী

[সম্পাদনা] কবিতা

  • অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩)
  • জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০)
  • সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫)
  • যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল (১৯৮৭)
  • আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০)
  • হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩)
  • আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৯৪)
  • কাফনে মোড়া অশ্রু বিন্দু (১৯৯৮)
  • কাব্য সংগ্রহ (১৯৯৮)
  • পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪)

[সম্পাদনা] কথাসাহিত্য

  • ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল (১৯৯৪)
  • সব কিছু ভেঙে পড়ে (১৯৯৫)
  • মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ (১৯৯৬)
  • যাদুকরের মৃত্যু (১৯৯৬)
  • শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার (১৯৯৭)
  • রাজনীতিবিদগণ (১৯৯৮)
  • কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ (১৯৯৯)
  • নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু (২০০০)
  • ফালি ফালি ক'রে কাটা চাঁদ (২০০১)
  • শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা (২০০২)
  • ১০,০০০, এবং আরো একটি ধর্ষণ (২০০৩)
  • একটি খুনের স্বপ্ন (২০০৪)
  • পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪)

[সম্পাদনা] সমালোচনা

  • শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৮৮)
  • ভাষা-আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি (১৯৯০)
  • নারী (১৯৯২)
  • প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে (১৯৯২)
  • নিবিড় নীলিমা (১৯৯২)
  • মাতাল তরণী (১৯৯২)
  • নরকে অনন্ত ঋতু (১৯৯২)
  • জলপাই রঙের অন্ধকার (১৯৯২)
  • রবীন্দ্র প্রবন্ধ/রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা (১৯৯৩)
  • শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা (১৯৯৩)
  • সীমাবদ্ধতার সূত্র (১৯৯৩)
  • আধার ও আধেয় (১৯৯৩)
  • আমার অবিশ্বাস (১৯৯৭)
  • পার্বত্য চট্টগ্রাম : সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা (১৯৯৭)
  • মহাবিশ্ব (২০০০)
  • দ্বিতীয় লিঙ্গ (মূল : সিমোন দ্য বোভোয়ার) (২০০১)
  • আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম (২০০৩)
  • ধর্মানভূতির উপকথা ও অন্যান্য (২০০৪)

[সম্পাদনা] ভাষাবিজ্ঞান

  • Pronominalization in Bengali (১৯৮৩)
  • বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র (১৯৮৩)
  • বাক্যতত্ত্ব (১৯৮৪)
  • বাঙলা ভাষা (প্রথম খন্ড) (১৯৮৪)
  • বাঙলা ভাষা (দ্বিতীয় খন্ড) (১৯৮৫)
  • তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান (১৯৮৮)
  • অর্থবিজ্ঞান (১৯৯৯)

[সম্পাদনা] কিশোরসাহিত্য

  • লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী (১৯৭৬)
  • ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা (১৯৮৫)
  • কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী (১৯৮৭)
  • আব্বুকে মনে পড়ে (১৯৮৯)
  • বুকপকেটে জোনাকিপোকা (১৯৯৩)
  • আমাদের শহরে একদল দেবদূত (১৯৯৬)
  • অন্ধকারে গন্ধরাজ (২০০৩)
  • Our Beautiful Bangladesh (২০০৪)

[সম্পাদনা] অন্যান্য

  • হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ (১৯৯২)
  • সাক্ষাৎকার (১৯৯৪)
  • আততায়ীদের সঙ্গে কথোপকথন (১৯৯৫)
  • বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় (১৯৯৭)
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা (১৯৯৭)[৫]

[সম্পাদনা] তথ্য সূত্র

  1. http://www.mukto-mona.com/banga_blog/?p=2103
  2. http://www.lekhok.net/humayun-azad/
  3. http://samakal.com.bd/details.php?news=17&view=archiev&y=2011&m=08&d=11&action=main&menu_type=&option=single&news_id=181353&pub_no=779&type=
  4. http://thedailysangbad.com/details.php?news=23&action=main&option=all&menu_type=&pub_no=87
  5. http://www.boiwala.com/writer.php?lang=bn&id=107